রাজধানীতে ভবন নির্মাণে শ্যালো মেশিন ও ডিজেলচালিত ইঞ্জিন দিয়ে চলছে পাইলিংয়ের কাজ। এতে বিধিমালার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি শব্দ সহ্য করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ফলে আইন না মেনে পাইলিংয়ের কাজে সৃষ্ট বিকট আওয়াজ মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, বিশেষ করে রোগীদের মধ্যে। এ অবস্থায় আধুনিক হাইড্রোলিক মেশিন ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলছেন পরিবেশ-নির্মাণ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
একটি বহুতল ভবন নির্মাণের প্রথম ধাপ পাইলিং। এজন্য ভারী যন্ত্রের মাধ্যমে ভবনের মূল খুঁটিগুলো গেড়ে দিতে হয় এক-দেড়শ ফুট মাটির নিচে। কিন্তু, পুরোনো পদ্ধতিতে পাইলিংয়ের এই কর্মযজ্ঞ তৈরি করে বিকট আওয়াজ। একজনের বাড়ি বানানোর বিকট আওয়াজের মাশুল দিতে হয় এলাকার অনেক মানুষকে। রাজধানীর বেশিরভাগ ভবন নির্মাণেই ব্যবহার করা হয় ডিজেলচালিত ইঞ্জিন ও শ্যালো মেশিন। ফলে কয়েকমাস ধরে জানালা বন্ধ রাখতে হয় আশপাশের বাসিন্দাদের।
‘পাইলিং’ হচ্ছে বিল্ডিং বা স্থাপনার এক ধরনের ফাউন্ডেশন যা স্থাপনার নিচে মাটির গভীরে লোড স্থানান্তর করে স্থাপনাকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে। এটা সাধারণত করা হয়ে থাকে যেসব জমিতে মাটির ভারবহন ক্ষমতা কম কিন্তু স্থাপনাটি বহুতলভিত্তিক। এটাকে স্থাপনার কলামের সঙ্গে তুলনা করা যায় যা মাটির গভীরে স্থাপিত হয়।
পাইলিং কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন- কাস্ট-ইন-সিটু পাইল, স্যান্ড পাইল, প্রি-কাস্ট পাইল, শোর পাইল, টিম্বার পাইল।
এগুলোর মধ্যে কাস্ট-ইন-সিটু পাইল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এটা সাধারণত সিলিন্ডারাকৃতির হয়ে থাকে, যার ব্যাস বা ডায়া ১৮ ইঞ্চি থেকে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটা আরো বেশি হতে পারে। আর দৈর্ঘ্য নির্ভর করে মাটির লেয়ারের উপর যা সয়েল টেস্ট রিপোর্টে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বহুতল স্থাপনার ভিত্তিতে এই পাইলিং ব্যবহৃত হয়েছে।
স্যান্ড পাইলের ধারণাটি অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও ক্ষেত্রবিশেষে এটি বেশ কার্যকর। সাধারণত কম তলাবিশিষ্ট স্থাপনা যেখানে মাটির ভারবহন ক্ষমতা কম সেখানে স্যান্ড পাইল করে সেটা বৃদ্ধি করা যায়। তবে অনেক তলাবিশিষ্ট ভবনের ক্ষেত্রে এটি ব্যাবহার করা যায় না।
প্রি-কাস্ট পাইলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পাইল আগে কাস্টিং বা ঢালাই করা হয় সুবিধামতো স্থানে (মাটির অভ্যন্তরে নয়)। এরপর এটি মেশিনের সাহায্যে বা হ্যামারিং করে সাইটের ভূমিতে যথাস্থানে ঢোকানো হয়।
শোর পাইল করা হয় মাটির পার্শ্বচাপ প্রতিরোধ করার জন্য। যেই সমস্ত স্থাপনায় বেসমেন্ট থাকে, কিংবা অন্য কোনো কারণে মাটি কাটতে হয়, সেখানে পাশের মাটি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাই এই ব্যবস্থা করা হয়। এটার সাথে শেয়ার ওয়ালের তুলনা করা যায়। এটা প্রি-কাস্ট বা কাস্ট-ইন-সিটু বা টিম্বার পাইল হতে পারে।
টিম্বার পাইল হলো গাছকে (সাধারণত শাল গাছের কাণ্ড) পাইল হিসেবে ব্যবহার করা। এটা ব্যবহার করা হয় কম তলাবিশিষ্ট ভবনে।
রাজধানীর মিরপুরে কয়েকটি পাইলিং মেশিনের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। এতে উঠে আসে ভয়াবহ চিত্র।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ভোর ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে শুরু হয় পাইলিংয়ের কাজ। তীব্র আওয়াজে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত হয়। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসুস্থ রোগী ও শিশুরা।
তারা আরো বলেন, বাচ্চাদের লেখাপড়াসহ সব দিক দিয়ে ক্ষতি হচ্ছে। আওয়াজে মেজাজ সবসময় চড়া হয়ে থাকে। তবে সেখান থেকে উত্তরণের জন্য বাসা পরিবর্তন করেও লাভ হয় না। কারণ যে এলাকায় যাই সেখানেই ভবন নির্মাণ কাজ চলছেই।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল হলেও, এই মেশিন সৃষ্টি করছে ১০০ থেকে ১৫০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায় যে শব্দ হওয়ার কথা তার থেকে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি।
বিধিমালার গাইড লাইনে বলা আছে, শব্দদূষণ নির্ধারিত মাত্রার বেশি হলে সেটা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি ৫৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ দূষণের মধ্যে ১৫ মিনিট বা তার বেশি নিয়মিত থাকলে বধির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে শব্দ দূষণমুক্ত পাইলিং করা হয় হাইড্রলিক মেশিনের মাধ্যমে। এ দেশেও বড় স্থাপনা কিংবা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে হচ্ছে এই যন্ত্রের ব্যবহার, কিন্তু সংখ্যায় খুবই কম। কারণ, পয়সা বাঁচাতে ডিজেল মেশিনই বেশি পছন্দ বাড়িওয়ালাদের।
আধুনিক হাইড্রলিক মেশিনে পাইলিং করার জন্য প্রতি বর্গফুটে খরচ হয় ৬০০ টাকা। আর শ্যালো মেশিন ও ডিজেলচালিত ইঞ্জিন দিয়ে পাইলিংয়ে খরচ হয় ২০০-২৫০ টাকা। ভবন নির্মাণকারীরা খরচ বাঁচাতে গিয়ে ব্যাপক শব্দদূষণ করছে, এর মূল্য কে দেবে? সেটাই এখন প্রশ্ন।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, নির্মাণ শিল্পে শ্রমিক এবং প্রতিবেশ সুরক্ষার যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে সেই বিষয়ে বিধিমালা তৈরি করা সত্ত্বেও এটি কার্যকর করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা না থাকার কারণে আমরা যাচ্ছেতাইভাবে শ্রমিকের নিরাপত্তা সাংঘাতিকভাবে অবহেলা করি। একই সঙ্গে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংসকারী কার্যক্রম নির্বিচারে চালিয়ে যাচ্ছি। ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণে শব্দ দূষণ হচ্ছে। সেই শব্দ প্রতিবেশীরা একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না। এটি দেখভাল করবে কে? এই প্রশ্নটি করলে দেখা যাবে শুভঙ্করের ফাঁকি।
আমাদের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড করা হয়েছে, তার জন্য যে কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা (বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি), সেটা করা হয়নি। আপনি দেখবেন এই নির্মাণ কার্যক্রম ও শ্রমিক-প্রতিবেশ সুরক্ষা বিধিমালা করা হয়েছে ২০১৩ সালে। এখন পর্যন্ত সেই কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য কোনো ধরনের মেকানিজম প্রস্তাব করা হয়নি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) দাঁত কেলিয়ে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে যে, ৯০ শতাংশ অবৈধ অথবা অনুমতি নিয়ে সেই অনুযায়ী করা হয়নি। তাদের যে কর্তব্য ছিল, সেটা পালনে অপারগতা-ব্যর্থতাকে তারা দাঁত কেলিয়ে জনগণের সামনে প্রকাশ করতেও দ্বিধান্বিত না। তাহলে এটা করবে কে?
সবশেষে থাকে সিটি কর্পোরেশন, যারা এখন পর্যন্ত মুখের কথায় সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাস্তবে মশা নিধন থেকে শুরু করে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসকারী নির্মাণের নামে যে কার্যক্রম চলছে, এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারের জন্য তারা জনগণের সরাসরি নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও এক্সারসাইজ করছে না। যদিও আমরা দীর্ঘদিন দাবি করে তাদের মন্ত্রীর পদমর্যাদা এনে দিয়েছি। তাহলে এটা করবে কে?
অতএব এখন বিধিমালা-আইন সবই গেজেটেড, বাস্তব প্রয়োগে এসবের কোনোটারই দর্শন আমরা দেখি না।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কতগুলো কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তারা এগুলোর জন্য দায়ী। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদফতর, যাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে তাদের লোকবল নেই। তাদের দায়িত্ব হলো এগুলো সম্পাদন করা। তাদের এ বিষয়ে নির্বিকারচিত্ত মনোভাব, এই সংগঠনগুলোকে নির্বিকার থাকায় আরো প্রশ্রয় দিচ্ছে।
শব্দদূষণ বিধিমালা অনুসারে, পরিবেশ অধিদফতরের নির্ধারিত শব্দের মাত্রা ভঙ্গ করলে, ১-৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু দেশে পাইলিংয়ের শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে এ আইন প্রয়োগের নজির নেই।